এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি? এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে করণীয়

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে করণীয়

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি? এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে করণীয় কি জানতে চান? তার আগে চলুন একটা করুণ ঘটনা সম্পর্কে জেনে নেই।

হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে একজন মুমূর্ষু রোগীর অপারেশন হচ্ছে। অপারেশন ঠিক ভাবেই হয়েছে। তবে কিছুদিন পরেই অপারেশনের কাটা অংশে ঘা দেখা দিলো। কোনো এন্টিবায়োটিক ই (antibiotic) পারলো না সেই ক্ষত সারিয়ে তুলতে। মানুষটির মৃত্যু হলো অসহায়ের মত। বিনা চিকিৎসায় নয়, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (Antibiotic Resistance) এর কারণে।  

গতকালই আমার এক ডাঃ ফেসবুক ফ্রেন্ড তার স্ট্যাটাসে জানালেন, গত ৩দিনে তিনি ৫জন একই রোগে আক্রান্ত রোগী পেয়েছেন, যাদের মাঝে ৩ জনের শরীরেই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স দেখা দিয়েছে।

আমরা প্রায়শই প্রাথমিকভাবে দ্রুত রোগ থেকে মুক্তি পেতে এন্টিবায়োটিক সেবন করি। কিন্তু, এখনই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি এবং করণীয় সম্পর্কে না জানলে ভীষণ কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

এন্টিবায়োটিক কি | what is Antibiotic? 

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি, তা জানার আগে বলুনতো এন্টিবায়োটিক কি? 

আমাদের শরীরে বিভিন্ন অনুজীবের কারণে সমস্যা দেখা দেয়। যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি। এদের মধ্যে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের পরিমাণ বেশি। কিছু ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ হলো যক্ষ্মা, টাইফয়েড, কলেরা, প্লেগ, হুপিংকাশি, ধনুষ্টংকার ইত্যাদি। 

ব্যাকটেরিয়া অনেক দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে, আর তাই  শরীরে ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ দেখা দিলে রোগ সারা শরীরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায়। এজন্য বংশবৃদ্ধি বন্ধ করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায়। 

এই ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিহত করার দুইটি উপায়, ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলা অথবা তাদের দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশবৃদ্ধি রোধ করা। এই উদ্দেশ্যে আমরা যে ঔষুধ সেবন করি সেগুলোকে এন্টিবায়োটিক ড্রাগ বলা হয়। এন্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাদের মেরে ফেলে অথবা বংশবৃদ্ধি বন্ধ করে দিয়ে।   

আমরা সবচেয়ে বড় ভুল করি যে ঠান্ডা লাগলে, সর্দি কাশি হলে এন্টিবায়োটিক খাই। অথচ ঠান্ডা, সাধারণ কাশি বা ফ্লু হয় ভাইরাসের আক্রমণে, ব্যাকটেরিয়ার কারণে নয়।  

তাহলে আপনি নিজেই ভেবে দেখুনতো, এন্টিবায়োটিক কি করে সাধারণ ঠান্ডা বা কাশি অর্থ্যাৎ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে? আর এখন আমরা অনেকেই কিন্তু না বুঝে করোনা চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক খেয়ে নিচ্ছি। অথচ, করোনা একটি ভাইরাস!  

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি | what is Antibiotic Resistance? 

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলো যে ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য আমরা এন্টিবায়োটিক খাই, সেই ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসের উপর, এন্টিবায়োটিক ঔষুধের কোন প্রভাব না পড়া। 

ধরুন, একদল সৈন্য শত্রুর বাড়িতে আক্রমণ করলো। সেই শত্রু কি বসে থাকবে? নিশ্চয়ই না। সে এমন কোনো ব্যবস্থা নিবে, যাতে সৈন্যদল তার বাড়িতে ঢুকতে না পারে বা তার কোনো ক্ষতি করতে না পারে। 

যদি কোনো ভাবে সে সফল হয়, তবেই সে সৈন্যদলের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে ফেললো। অর্থ্যাৎ প্রতিরোধ তৈরি করে ফেললো তবে সৈন্যদল কিন্তু শত্রুর কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা।  

একই ভাবে ব্যাকটেরিয়াও নিজেকে এমন ভাবে পরিবর্তন করে নেয়, যাতে এন্টিবায়োটিক কোনো ভাবেই ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। আর তখনই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। কিন্তু এই রেজিস্ট্যান্স এমনি এমনি তৈরি হয়নি। 

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরির কারণ | Causes of antibiotic resistance? 

আচ্ছা ভাবুন তো, সেই শত্রুরা কেনো রেজিস্ট্যান্স তৈরি করতে পারলো? সৈন্যদল নিশ্চয়ই ভুল নিয়মে আক্রমণ করেছিলো বা শত্রুকে রেজিস্ট্যান্স হওয়ার সময় – সুযোগ দিয়েছিলো!  

আমরা নিজেরাই আসলে ব্যাকটেরিয়াকে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হতে সাহায্য করি। কি করে?  

আমরা নিজের ইচ্ছেমতো এন্টিবায়োটিক খেয়ে নেই। আবার বেশির ভাগ সময়েই এন্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করিনা, মনের ভুলে কিংবা ইচ্ছাকৃত ভাবে। এতে করে ব্যাকটেরিয়া নিজেকে পরিবর্তন করার সুযোগ পেয়ে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়। 

পরবর্তীতে আক্রমণ করতে গেলে তারা Antibiotic কাজ শুরু করার আগেই চিনে নেয়, আর নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুরক্ষিত করে ফেলে। ফলে পরবর্তীতে সেই এন্টিবায়োটিক আর ওই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারেনা। 

আবার যেহেতু ব্যাকটেরিয়া অতি দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, তাই নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরিও সহজ নয়। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হলো; 

  • ঘনঘন এন্টিবায়োটিক খেলে শরীরে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (Antibiotic Resistance) তৈরি হয়।   
  • আবার একই সাথে অনেকগুলো এন্টিবায়োটিক খেলে কোনোটাই ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনা, বরং রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়।  
  • পশু বা প্রাণী থেকেও কিন্তু এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হতে পারে। পশু মোটা তাজা করতে অনেকেই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন। এতে ওই পশুর যেমন এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়, তেমনি মানুষের মাঝেও রোগ ছড়ায়।  

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে কি ক্ষতি হয়?  

  • অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যান্সার থেরাপি, সিজার সহ অন্যান্য রোগ যেমন ডায়াবেটিস, অ্যাজমা রোগীদের এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে গুরুতর অবস্থা, এমন কি মৃত্যুও হতে পারে।  
  • কিছু কিছু এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া একজন থেকে অন্যজনে ছড়াতে পারে। এমনকি পশু থেকে মানুষে এবং ছড়িয়ে পড়তে পারে পরিবেশেও।  
  • কৃষি ক্ষেত্রেও করতে পারে অনেক ক্ষতি। 
  • এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে হওয়া ইনফ্যাকশানগুলোর চিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন, বেশির ভাগ সময়েই অসম্ভব। 

নিয়ম না মেনে এন্টিবায়োটিক খেলে কিন্তু শুধু রেজিস্ট্যান্সই হয়না, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও নষ্ট হয়। আমাদের শরীরে কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে যা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে। নিয়ম না মেনে এন্টিবায়োটিক খেলে এই ভালো ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। ফলে আমাদের  রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।  

এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকায় প্রতি বছর ২.৮ মিলিয়ন মানুষ এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের শিকার হয়, মৃত্যু হয় প্রায় ৩৫০০০! এর প্রধান কারণ অসচেতনতা এবং দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থা।  

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে করণীয় | How to prevent antibiotic resistance? 

  • এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সে আমাদের সর্বপ্রথম করণীয় হলো, সুস্থ থাকার চেষ্টা করা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া । কেনো? কারণ সবচেয়ে সহজ উপায় হলো এন্টিবায়োটিক না খাওয়া । রোগ নেই, তো রেজিস্ট্যান্সও নেই।  
  • যদি কোনো কারণে এন্টিবায়োটিক খেতেই হয়, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া না খাওয়াই ভালো। 
  • অবশ্যই অবশ্যই পুরো কোর্স শেষ করতে হবে, কোনো ভাবেই মাঝখানে বন্ধ করে দেয়া যাবেনা।  

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে শেষ কথা

আমরা অনেকেই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের (Antibiotic Resitance) বিষয়ে এখনো জানিই না। অথচ, এটি পুরো পৃথিবীতে ভয়াবহতা তৈরি করেছে। মৃত্যুর হার মরণ ব্যাধি ক্যান্সার কেও ছাড়িয়ে গেছে! 

দেহ এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট (Antibiotic Resitstant) হয়ে গেলে সাধারণ হয়ে আসা যক্ষ্মা, কলেরা রোগে আবারও প্রাণ যাবে কোটি কোটি মানুষের।কারণ এন্টিবায়োটিক সাধারণত সর্বোচ্চ পাওয়ারফুল মেডিসিন হয়ে থাকে। সেই এন্টিবায়োটিক যদি ব্যর্থ হতে শুরু করে তবে আর কোনো মেডিসিনেই লাভ হবেনা। 

এমন অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের ভিতর বছরে ১০মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হবে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে। যা তৈরি করতে পারে নতুন কোনো মহামারী। এখনই কি সময় নয় আমাদের সচেতন হওয়ার? 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top