খেজুর খাওয়ার উপকারিতা | dry dates benefits

খেজুর খাওয়ার উপকারিতা

খেজুর খাওয়ার উপকারিতা : আসছে রোজার মাস, এই মাসে প্রতিটি রোজাদারের ইফতারের নিত্য সঙ্গী হলো খেজুর। খেজুর ছাড়া যেনো ইফতারের একটি অংশ এক কথায় অপূর্ণই থেকে যায়! তাছাড়া খেজুর খাওয়ার উপকারিতা এত বেশি যে বলে শেষ করা সম্ভব না। প্রতিদিন নিয়মিত খেজুর খেলে বিভিন্ন জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। খেজুর আমাদের রাসূল (সাঃ) এর প্রিয় খাবারও ছিল। তাই মুসলমানদের জন্য খেজুর খাওয়া সুন্নত।

খেজুর মূলত গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের ফল। পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকরী ফল হিসেবে সারাবিশ্বে এর জুড়ি নেই। বৈজ্ঞানিকভাবে, এটি Arecaceae পরিবারভুক্ত ফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix Dactylifera.

বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’। কিন্তু, এই খেজুরে রয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার হাজারো সমাধান। যা এক কথায় এক ঢিলে হাজারো পাখি মারার সমান।

অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি যদি নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলে তবে চূড়ান্তভাবে সে অনেক জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাবে। খেজুর খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, এতে থাকা নানাবিধ পুষ্টি উপাদান যেমন শরীরকে সুস্থ রাখবে তেমনি এর এন্টিঅক্সিডেন্ট এজেন্ট সমুহ শরীরকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচাবে।

পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি ফল হলো এই খেজুর। সচরাচর আমরা যে খেজুর খেয়ে থাকি তা হলো শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা খেজুর আর পুষ্টি উপাদান এতেই থাকে অনেক বেশি। অর্থাৎ, পুষ্টিমানের দিক থেকে কাঁচা খেজুরের চাইতে শুকনো খেজুরের অবস্থান উপরে। তবে, এর ক্যালরীমান বিভিন্ন শুকনো ফল তথা ড্রাইড ফ্রুটস যেমন কিশমিশ, ডুমুর এগুলোর মতোই।

খেজুরের বেশির ভাগ ক্যালরী আসে এর শর্করা অংশ থেকে। বাকি অংশে থাকে খুবই অল্প পরিমাণ প্রোটিন। এর পাশাপাশি থাকে শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু খনিজ লবণ, ভিটামিন ও ফাইবার।

৩.৫ আউন্স অথবা ১০০গ্রাম খেজুর এ থাকা পুষ্টি উপাদান গুলো হলো:

  • ক্যালরি: ২৭৭ গ্রাম
  • পটাশিয়াম: ২০%আরডিআই
  • শর্করা: ৭৫গ্রাম
  • ম্যাগনেসিয়াম: ১৪%আরডিআই
  • কপার: ১৮% আরডিআই
  • ম্যাঙ্গানিজ: ১৫% আরডিআই
  • আয়রন: ৫% আরডিআই
  • ভিটামিন বি৬: ১২% আরডিআই [ RDI : Reference Daily Intake]

এসব পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি এতে আছে উচ্চমানের এন্টিঅক্সিডেন্ট যা শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খেজুর খাওয়ার উপকারিতা : Benefits of Dry Dates

আমরা আজকের প্রবন্ধে জানবো খেজুর খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে। তবে আর দেরি কেন! চলুন তবে জেনে নেই আমাদের অতি পরিচিত খেজুরের উপকারিতা সম্পর্কে।

১. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার

শরীরের সার্বিক সুস্থতার জন্য ফাইবার যুক্ত খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই চাহিদা পূরণে খাদ্যতালিকায় যদি এমন কিছু থাকে যার মাত্র ৩.৫ আউন্সেই পাওয়া যাবে ৭ গ্রাম ফাইবার তাহলে তো কথাই নেই। হ্যাঁ! খেজুর হচ্ছে খাদ্যতালিকার সেই ফল যার ৩.৫ আউন্সেই মিটবে শরীরের দৈনিক ফাইবারের চাহিদা।

ফাইবার জাতীয় খাদ্য কোষ্ঠকাঠিন্য, হজমের গোলমাল সহ এ ধরনের যাবতীয় সমস্যা সমাধান করে দেহের সুস্থতা নিশ্চিত করে।

২১ জন স্বেচ্ছাসেবকের অংশগ্রহনে করা একটি জরিপের তথ্যে জানা গেছে যে এদের প্রত্যেককে প্রতিদিন ৭টি করে খেজুর খেতে বলা হয়েছিলো। ২১ দিনের মাথায় ফলাফল পাওয়া গিয়েছিলো যে তাদের প্রায় প্রত্যেকের থাকা হজমের গোলমাল ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যার সমাধানে এটা অনেক কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।

এছাড়াও, এই ফাইবার রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতেও যথেষ্ট কার্যকর। এটি খাদ্য হজমকে ধীরজ করার পাশাপাশি খাওয়ার সাথে সাথেই রক্তের গ্লুকোজ লেভেল অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়াকে প্রশমিত করে।

২. খেজুরে আছে রোগ প্রতিরোধী এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ

খেজুর আমাদের দেহে বিভিন্ন ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্টের যোগান দেয় যা বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা থেকে আমাদের রেহাই দিতে পারে।

আরো পড়ুন:  রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস : ইফতার ও সেহরীতে কি খাবেন, কি খাবেন না

এসব এন্টিঅক্সিডেন্টগুলো দেহের কোষ থেকে ফ্রি রেডিকেল গুলো দূর করে। এই ফ্রি রেডিকেল গুলো মূলত অস্থিতিশীল কিছু মলিকিউল যা সার্বিকভাবে দেহকে কোনো সাংঘাতিক দূরারোগ্য ব্যাধির দিকে ঠেলে দিতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের ফল যেমন শুকনা ডুমুর অথবা বরই এর সাথে তুলনা করে দেখা গেছে শুকনা খেজুরেই সর্বাধিক এন্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান।

গবেষকদের গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই কিছু এন্টিঅক্সিডেন্টের নাম ও কাজ। চলুন এবারে জেনে নেই সেগুলো সম্পর্কে।

ফ্লাভিনয়েডস :এই এন্টিঅক্সিডেন্টটি খুবই শক্তিশালী ধরনের রোগ প্রতিরোধকারী। এটি প্রদাহ যন্ত্রনা কমাতে সহায়ক। গবেষণায় উঠে এসেছে এটি ডায়াবেটিস, অ্যালজেহেইমারসহ কিছু কিছু ক্যান্সারের ঝুকিও কমায়।

অ্যালজেহেইমার: এটি একটি মস্তিষ্কের রোগ যা সাধারণত ৪০/৫০ বছরের মানুষের মধ্যে দেখা যায়।এর প্রথম লক্ষণ হলো স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়া।এই রোগ বাড়তে থাকার এক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি পুরোপুরি ভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এটি ধীরে ধীরে মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে।

ক্যারোটিনয়েডস: হৃৎপিণ্ডের সুরক্ষা ও বিভিন্ন ধরনের চোখের সমস্যা যেমন ম্যাকিউলার ডিজেনারেশনের ঝুঁকি কমাতে এই এন্টিঅক্সিডেন্টের কার্যকারী ভূমিকা প্রমাণিত।

ফেনোলিক এসিড: ফ্ল্যাভিনয়েডসের মতোই এটিও একটি প্রদাহ প্রতিরোধক এন্টিঅক্সিডেন্ট। এটি প্রদাহ যন্ত্রণা কমানোর পাশাপাশি ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকিও কমায়।

৩. খেজুর মস্তিষ্কের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে

নিয়মিত খেজুর খাওয়া মস্তিষ্কের সুস্থতার সহায়ক। ব্রেনের ফাংশনাল কার্যক্রমের ধারাবাহিক উন্নতিতে খেজুর কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

ল্যাবেরেটরি গবেষণার তথ্যমতে, খেজুর মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগের হার কমিয়ে আনে।উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, Interleukin 6 (IL-6) হলো এমন একটি মার্কার যার উচ্চমাত্রা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্মের ব্যত্যয় ঘটায়। খেজুরে থাকা উপাদান এই মার্কারটির বেড়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

এছাড়া স্ট্রোকের অন্যতম কারণ হলো মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্তপ্রবাহের বাঁধাদানকারী প্লাকের সৃষ্টি হওয়া। নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস স্ট্রোকের শারীরিক ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

সর্বোপরি, গবেষকগণ মস্তিষ্কের সুস্থতায় খেজুর খাওয়ার আরও উপকারিতা আবিষ্কারের জন্য বিস্তৃত পরিসরে গবেষণার আহ্বান করেছেন।

৪. খেজুর প্রসব বেদনা কমাতে ভূমিকা রাখে

গর্ভবতী নারীদের প্রসব বেদনা কমানোর ক্ষেত্রে খেজুরের সম্ভাবনা কতটুকু তার উপর ব্যপক গবেষনার পর গবেষকগন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, গর্ভাবস্থার শেষের কয়েক সপ্তাহ নিয়মিত খেজুর গ্রহণ জরায়ুজ সংকোচন প্রভাবিত করে এবং প্রসব সহজ করে।

৬৯ জন গর্ভবতী নারীদের নিয়ে করা একটি জরিপের ফলাফল জানায়, গর্ভাবস্থার শেষ সপ্তাহগুলিতে যেসব নারীরা প্রতিদিন ৬ টি করে খেজুর খেয়েছেন তারা ভালো ফল পেয়েছেন। তবে যারা খান নি তারা তাদের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়েছেন।

অন্য আরেকটি গবেষণায় যেখানে ১৫৪ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন তাদের জরিপেও খেজুর খাওয়ার উপকারিতা পাওয়া যায়।

তৃতীয় ধাপের আরেকটি জরিপের ফলাফল সবচাইতে ভালো আসে। সেখানে দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় খেজুর খেয়ে উপকারিতা পেয়েছেন ৯১% নারী।

গবেষকগণ মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, খেজুরে থাকা উপাদান সমুহ সম্ভবত অক্সিটোসিন হরমোনের কার্যকলাপ প্রভাবিত করে এবং প্রাকৃতিক ভাবে সন্তান প্রসবকে ত্বরান্বিত করে। এই অক্সিটোসিন হরমোন হলো সেই হরমোন যা মুলত জরায়ুজ সংকোচনের জন্য দায়ী।

এছাড়াও, এতে আছে ট্যানিন যা প্রসব সহজতর করার পেছনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। খেজুরে যেহেতু প্রাকৃতিকভাবেই চিনি ও ক্যালরি সঞ্চিত থাকে তাই প্রসবকালীন শারীরিক শক্তি প্রদানেও এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

তিন তিনটি জরিপের ভালো ফলাফল পাওয়ার পরও গবেষকগণ আরও বিস্তৃত গবেষণার আহ্বান করেছেন।

৫. খেজুর ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক

ক্যান্সার একটি মারাত্মক ব্যাধি যা প্রতিবছরই বিশ্বব্যাপী অনেকগুলো জীবনহানির পাশাপাশি যে কোনো দেশের স্বাস্থ্যখাতেরও আর্থিক ক্ষতি সাধন করে। তবে, ইদানিং এর হার একটু হলেও কমে আসছে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এই সাফল্য বর্তায় আমজনতার উপরই যারা খুব দ্রুত নিজেদের জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন।

গবেষকগণ খেজুরের কিছু বৈশিষ্ট্যসূচক উপাদানসমূহ নিয়ে গভীরভাবে গবেষণার পর জানিয়েছেন যে, এতে থাকা বিটা-ডি গ্লুকান শরীরে টিউমার প্রতিরোধক হিসেবে কার্যকরী।

জেনেটিক মিউটেশনের ফলে কোষের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে যা সার্বিকভাবে দেহের জন্য বিপদ ডেকে আনে। কোষের এই দ্রুত বৃদ্ধিতে সৃষ্টি হয় টিউমার যার অন্তিম রূপ ক্যান্সার। খেজুর এ রয়েছে সহজাত এন্টিজেনোটক্সিক উপাদান যা CPY-450 এর অ্যারোমাটেজ কার্যকারীতা কমাতে সাহায্য করে এবং অ্যালকাইল রেডিকেলগুলোর শনাক্তকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জেনেটিক মিউটেশন চলার সময় দেহে এবং কোষাভ্যন্তরে সৃষ্টি হয় মিথেন ডায়াজোনিয়াম আয়ন। যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই আয়নের কার্যকারিতা নিঃশেষ করতেও খেজুরের এন্টিটক্সিক উপাদানের বিশেষ ভূমিকা আছে।

আরো পড়ুন:  রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস : ইফতার ও সেহরীতে কি খাবেন, কি খাবেন না

এতে থাকা উচ্চ মাত্রার এন্টিঅক্সিডেন্টের ঘনত্ব ফ্রি রেডিকেল গুলো কার্যকারীতা কমিয়ে দেয় যার ফলে ক্যান্সার হওয়ার সুযোগ কমে যায়।

তাই, নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করার পাশাপাশি ক্ষতিকর টিউমারের সম্ভাবনা কমিয়ে শরীরের সুস্থতা নিশ্চিত করে।

৬. খেজুরে আছে মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা

ব্যাকটেরিয়া জনিত সংক্রমণগুলো সাধারণত খুবই মারাত্মক হয় এবং এর জন্য অনেক দীর্ঘ সময় ব্যাপী চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। বর্তমান মেডিকেল রিপোর্ট সমূহ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ ধরনের বেশিরভাগ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় অসম্ভব ব্যয়বহুল কিছু এন্টিবায়োটিক যা আবার নিয়ে আসে বস্তাপচা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

কেউ যদি নিয়মিত মাত্র ৬/৭ টি করে খেজুর খাওয়ার অভ্যাস রাখে তাহলে এ ধরনের ব্যকটেরিয়া জনিত সংক্রমণ থেকে প্রাকৃতিকভাবেই মুক্তি মিলবে।

একটি জরিপে দেখা গেছে, খেজুরের পাতা ও ফলের নির্যাস বেশ কিছু ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম।

আরেকটি গবেষণা করা হয়েছিলো খেজুরের নির্যাসের সাথে অ্যাসিটোন ও মিথানল যোগ করে। ফলাফলে দেখা গিয়েছে এই মিশ্রণটি বেশ কিছু গ্রাম পজিটিভ ও গ্রাম নেগেটিভ ব্যকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধির পথে হুমকিস্বরূপ।

এছাড়া, আরো কিছু গবেষণার ফলাফল এই যে, খেজুরে বিদ্যমান অসাধারণ সব এন্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যাবলী মারাত্মক কিছু মাইক্রোবস যেমন ই-কোলি ও নিউমোনিয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

খেজুরের এই নির্যাস বিভিন্ন উচ্চমাত্রার এন্টিবায়োটিক অথবা অন্যান্য ঔষধ যেমন মিথাইলপ্রেনিসোলন এর মতো ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কাটিয়ে উঠতেও সহায়তা করে।

খেজুরের এই বৈশিষ্ট্যের জন্য একে স্বাস্থ্য সচেতন ব্যাক্তিবর্গের খাদ্যতালিকায় যুক্ত করা এখন সময়ের দাবী।যদিও, অন্যান্য ফলেও রোগ প্রতিরোধী এন্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান গুলো রয়েছে তবুও মানবদেহের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকরী উপাদান একমাত্র খেজুরেই বিদ্যমান।

৭. খেজুর ডায়াবেটিস প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে

বর্তমান বিশ্বে রোগ-ব্যাধীর তালিকায় যে রোগটি এক নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে তা হলো- ডায়াবেটিস মেলিটাস। ইদানিং এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির সংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যা বরাবরই কল্পনার অতীত। একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই রোগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির পেছনের মূল কারণ! তারা বলেছে, অস্বাস্থ্যকর ফাস্ট ফুড এবং অনিয়মিত ও অপরিকল্পিত খাদ্যাভাসই এর ধারাবাহিক বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বেশিরভাগ রোগীরাই কৃত্রিম ঔষধ গ্রহণ করে থাকেন, কারো কারো নেয়া লাগে ইনসুলিন। অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসার পাশাপাশি এসব ঔষধ বারংবার গ্রহণের ফলে রোগীর সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই, এই রোগের চিকিৎসায় প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার আজ সময়ের দাবী। এ নিয়ে চলছে ব্যপক গবেষণাও।

বিভিন্ন গবেষণা হতে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য হলো- খেজুরে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান গুলো শরীরে ইনসুলিন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সক্ষম। এর আরো কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্ত্রে গ্লুকোজ শোষণের হার কমাতে সাহায্য করে।আর অন্ত্রের গ্লুকোজের কম শোষণ অবধারিতভাবেই রক্তের গ্লুকোজের কম শোষণেও ভূমিকা রাখে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অনেক বেশি সহায়ক।

এছাড়া, এইসব উপাদান ডায়াবেটিস হওয়ার অন্যান্য সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরসনেও ভূমিকা রাখে। নিয়মিত খেজুর গ্রহণ তাই হতে পারে ডায়াবেটিস রোগের অথবা ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধের মহৌষধ। তবে, ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় খেজুরের সত্যিকারের অবদান জানার প্রয়াসে এখনো বিস্তর গবেষণা চলছে।

৮. কিডনির সুরক্ষায় খেজুর

কিডনি জটিলতা আজকে বিশ্বব্যাপী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেফ্রোলোজিক্যাল ফাংশন বা বৃক্কের কার্যক্রমের সার্বিক সুস্থতা মূলত কোনো মানুষের দৈহিক সুস্থতার বাহ্যিক প্রতিফলন। কিন্তু, মানুষের নিত্যদিনের শারীরিক অবহেলা আর অনিয়মিত ডায়েটিং এর ফলাফলই বিশ্বজুড়ে আজকের এই অবস্থার কারণ। বিভিন্ন মেডিকেলের রিপোর্ট পর্যালোচনায় এসেছে যে প্রতিদিনই প্রায় লাখো মানুষের ভীড় জমছে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের অপেক্ষমাণ তালিকায়। আর অন্য দিকে বাড়ছে কিডনী কালো বাজারী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য! এদের সামলাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ এই কিডনি যার সুস্থতা দেহের সুস্থতা নিশ্চিত করে তার যত্ন নেয়া অতীব জরুরী।

আরো পড়ুন:  রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস : ইফতার ও সেহরীতে কি খাবেন, কি খাবেন না

খেজুরে রয়েছে কিডনিকে সুরক্ষা দানকারী কিছু উপাদান। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ‘আজওয়া’ খেজুর যা মূলত মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় পাওয়া যায় তার রয়েছে কিডনির ক্ষত সারানোর আশ্চর্য ক্ষমতা।এই খেজুর আক্রান্ত স্থানে খুব দ্রুত কাজ করে আর সেখানে গড়ে তোলে আরেকটি লেয়ার বা স্তর যা ধীরে ধীরে ক্ষতকে সারিয়ে তুলতে কার্যকর।

৯. পুরুষের বন্ধ্যাত্ব সমস্যার সমাধানে

বর্তমান সময়ে বন্ধ্যাত্ব একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে গিয়েছে ব্যাপক সংখ্যক দম্পতির জন্য।পুরুষের বন্ধ্যাত্বের বৈশ্বিক রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দিন কে দিন এই সমস্যা বেড়েই চলেছে এবং উন্নত বিশ্বের কিছু দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মানুষের পরিবর্তনশীল জীবন ব্যবস্থা যা অনাবশ্যক শারীরিক ও মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে তাই মূলত এর পেছনের কারণ। ধূমপান, মদ্যপান এবং অতিরিক্ত যান্ত্রিক হয়ে যাওয়াটাকে পুরুষের বন্ধ্যাত্বের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে।

তবে এর চিকিৎসায় ও ভালো ফলাফল মিলেছে খেজুরের মধ্যে।এতে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খনিজ লবণ যা শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সেক্সুয়াল স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি সাধন করে। একটি গবেষণা তথ্য জানিয়েছে নিয়মিত খাদ্যতালিকায় খেজুর থাকাটা পুরুষের অকাল বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি দানের পাশাপাশি টেস্টিসের আকার ও বৃদ্ধি করে।

খেজুরে থাকা ফ্লাভিনয়েড ও বিভিন্ন ধরনের অ্যামিনো এসিডের উপস্থিতিই মূলত এই সমস্যা সমাধানে কার্যককী ভূমিকা রাখে। এছাড়া, কিছু কিছু মাইক্রো উপাদান যেমন এস্ট্রেরন, স্টেরল ইত্যাদির কার্যকারীতাও গ্রহণযোগ্য।তবে, এ বিষয়ে এখনো বিস্তৃত গবেষণা চলছে।

১০. ত্বকের যত্নে খেজুর

নিত্য-নৈমিত্তিক অযত্নে আর অবহেলায় অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সাথে ত্বকের বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও বেড়ে চলেছে।এদের মোকাবিলায় দেদারসে ব্যবহৃত হচ্ছে নানারকম কৃত্রিম প্রসাধন সামগ্রী যারা খুব দ্রুত সাময়িক মুক্তি দিলেও স্থায়ীভাবে ত্বকের আসল সৌন্দর্য বিনষ্ট করে দেয়। এছাড়া, শরীরের বিভিন্ন স্থানে অবাঞ্ছিত র‌্যাশের উদ্ভব ঘটাতে পারে। যা সার্বিকভাবে শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস তৈরী করা হতে পারে এর চমৎকার বিকল্প।এতে থাকা ভিটামিন সিভিটামিন ডি ত্বকের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ধরে রাখার পাশাপাশি ত্বকের নমনীয়তা বৃদ্ধি করে। এর পুষ্টি উপাদান ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না ফলে অনেক দিন পর্যন্ত তারুণ্য ধরে রাখা যায়। এটা ত্বকের মেলানিনের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

১১. হাড়ের সুস্থতায় খেজুরের উপকারিতা

খেজুরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খনিজ লবণ যেমন ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি। এই প্রত্যেকটি উপাদানই হাড়ের গঠনে ও সুস্থতা বজায় রাখতে দারুণ সহায়ক।হাড়ের বিভিন্ন রোগের মধ্যে অস্টিওপরোসিস খুব কঠিন একটি রোগ যা বয়স্কদের একদম অসহায় করে দেয়। তরুণ বয়স থেকে নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস এই রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারে।

১২. প্রাকৃতিক সুইটেনার হিসেবে খেজুর

প্রাকৃতিক চিনি বলা হয় ফ্রুক্টোজকে। আর এই ফ্রুক্টোজের একটি ভালে উৎস হলো এই খেজুর।

এজন্য এটি খেতে অসম্ভব মিষ্টি হয় যদিও কিছু জাত পাওয়া যায় যা তুলনামূলকভাবে কম মিষ্টি। এতে হালকা ক্যারামেল ফ্লেভারও পাওয়া যায়। কোনো মিষ্টি জাতীয় খাদ্যে সাদা চিনির বদলে সরাসরি খেজুর ব্যবহার করা যেতে পারে। খাদ্যে এর ব্যবহার একই সঙ্গে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, ফাইবার ও এন্টিঅক্সিডেন্টের যোগান দিতে পারে যা সাধারণ চিনি পারে না।

চিনির বদলে খেজুর ব্যবহার করার জন্য খেজুর পেস্ট ও পানি ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে ব্যবহার করা যায়।মিষ্টতার দিক দিয়ে চিনির সাথে এর অনুপাত ১:১। অর্থাৎ, কোনো খাবারে যদি এককাপ পরিমাণ চিনি দেয়ার প্রয়োজন হয় তবে তার পরিবর্তে এককাপ পরিমান খেজুরের পেস্ট দেয়া যাবে।

খেজুর খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে শেষ কথা

চিকিৎসা শাস্ত্রে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় আর তা হলো ‘প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম’। হ্যাঁ! নিয়মিত খাদ্যতালিকার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে যদি খেজুরকে রাখা যায় তাহলে দেহের সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। এতে করে শরীর সহজেই কোনো রোগে আক্রান্ত হবে না; পাওয়া যাবে নীরোগ, সুস্থ দীর্ঘ জীবন। শারীরিক সুস্থতার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও। সর্বোপরি, ব্যক্তিগত জীবনে আসবে সাচ্ছন্দ্য।

পুরো প্রবন্ধে আমরা খেজুর খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। একান্তই নিজ নিজ স্বাস্থ্যোপকারিতার দিকে নজর দিয়ে আমাদের উচিত নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।

তবে, খেজুর খাওয়ার অনেক উপকারিতা থাকলেও লক্ষ্য রাখতে হবে এতে যথেষ্ট পুষ্টি উপাদান এবং উচ্চমাত্রার ক্যালরীও আছে। তাই ব্যবহারে সংযমী হওয়াই ভালো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top