মানুষ কয়েক শতাব্দী ধরে গ্রিন টি এর স্বাস্থ্য উপকারের প্রশংসা করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গ্রিন টি সেবন করা ত্বকের স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, ওজন হ্রাসে সহায়তা করতে পারে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
International Institute of Sustainable Development একটি প্রতিবেদন অনুসারে, পানির পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পান করা পানীয় হলো চা।
ভেষজ ব্যতীত সমস্ত চায়ের ধরণের ক্যামেলিয়া সিনেনেসিস বুশের শুকনো পাতা থেকে তৈরি করা হয়। পাতার অক্সিডেশন স্তরটি চায়ের ধরণ নির্ধারণ করে।
গ্রিন টি আনঅক্সিডাইজড পাতা থেকে তৈরি হয় এবং চা হলো সবচেয়ে কম প্রক্রিয়াজাত চায়ের মাঝে একটি। এই কারণে, এতে সর্বাধিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং উপকারী পলিফেনল রয়েছে।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
গ্রীন টি এর উপকারিতা ও অপকারিতা
পুরো বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সচেতনতায় বহুলাংশে ব্যবহৃত একটি অন্যতম পানীয়ের নাম গ্রীন টি। গ্রীন টি এর উপকারিতা নিয়ে জোর প্রচারণাও চলেছে। শুধু চীন, জাপান, কোরিয়াতেই নয়, বরং ভারত ও বাংলাদেশেও আজকাল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই গ্রীন টি।
গ্রীন টি নিয়ে এত প্রচারণার পর অনেকেই এখন এটা বুঝেন যে সাধারণ চা এর চেয়ে গ্রীন টি এর উপকারিতা বেশি। কিন্তু আপনি কি জানেন কিভাবে গ্রিন টি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে? কিংবা গ্রিন টি কি কি উপকার করে!
তাছাড়া, গ্রিন টি কি শুধু উপকারই করে! নাকি অপকারিতা বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও আছে?
গ্রীন টি এর উপকারিতা জেনে নেওয়ার আগে চলুন একনজরে গ্রিান টি কি সেসম্পর্কে কিছু প্রাথমিক তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
গ্রীন টি কি?
গ্রীন টি ’ক্যামেলিয়া সিনেনসিস (Camellia sinensis)’ উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত এক প্রকার স্বাস্থ্যকর চা। জরিপে দেখা গিয়েছে, পৃথিবীতে মোট ব্যবহৃত চায়ের পরিমাণের প্রায় ২০ শতাংশই গ্রীন টি বা সবুজ চা।
হাজার হাজার বছর ধরে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিদ্যায় চীন এবং জাপানের অধিবাসীরা গ্রীন টি ব্যবহার করে আসছেন।
তবে বর্তমান বিশ্বে গ্রীন টি এর ব্যবহার বেশি দেখা যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান ওজন হ্রাস, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ এবং বিপাকক্রিয়ার সঠিক হার নিয়ন্ত্রণে।
গ্রীন টি কীভাবে প্রস্তুত করা হয়?
ব্ল্যাক টি, ওলং টি (oolong tea) সহ পৃথিবীর বেশিরভাগ চা-ই মূলত ক্যামেলিয়া সিনেনসিস উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত। তবে গ্রীন টি এর প্রস্তুত প্রক্রিয়াটি একটু আলাদা।
একমাত্র হারবাল টি অর্থাৎ ভেষজ চা ব্যতীত সকল প্রকার চা-ই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস উদ্ভিদের শুকনো পাতা এবং পাতার কুঁড়ি থেকে তৈরি হয়। শুকনো পাতার অক্সিডেশন লেভেল (oxidation level) এর উপর নির্ভর করে যে কোন চায়ের বৈশিষ্ট্য এবং প্রকারভেদ কেমন হবে।
গ্রীন টি সচরাচর আনঅক্সিডাইজড পাতা থেকে তৈরি হয়, যা পৃথিবীর সবচেয়ে কম প্রক্রিয়াজাত চায়ের মাঝে একটি।
ক্যামেলিয়া সিনেনসিস উদ্ভিদের বেশিরভাগ তাজা পাতা এবং কুঁড়িকে প্রথমে বেশ উচ্চ তাপমাত্রায় বাষ্পীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাপিয়ে নেয়া হয়। অতঃপর সেগুলোকে প্যানে ফ্রাই করে শুকানো হয়।
মনে রাখতে হবে, গ্রীন টি কখনোই ফার্মেন্টেশন (fermentation) প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়না। কেননা গ্রীন টি প্রস্তুতের সময় খেয়াল রাখা হয় যেন উদ্ভিদের পাতায় বিদ্যমান পলিফেনল (polyphenol) নামক রাসায়নিক উপাদানটি অক্ষুণ্ণ থাকে।
উল্লেখ্য, পলিফেনলের কারণেই গ্রীন টি বেশ উপাদেয় এবং স্বাস্থ্যকর।
গ্রীন টি এর প্রকারভেদ
প্রস্তুত প্রক্রিয়ার ধরণে ভিন্নতার জন্যেও গ্রীন টি এর প্রকারভেদ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন:
- সামান্য মিষ্টি স্বাদের বোতলজাত গ্রীন টি
- টি ব্যাগ
- লুজ লিফ (loose-leaf) অর্থাৎ শুধুমাত্র শুকনো পাতা
- ইনস্ট্যান্ট পাউডার
- গ্রীন টি সাপ্লিমেন্ট, যা ক্যাপসুল কিংবা তরলজাত প্রক্রিয়ায় পাওয়া যায়।
২০১০ সালে অ্যামেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি কর্তৃক প্রাপ্ত একটি গবেষণা মোতাবেক, বোতলজাত মিষ্টি স্বাদের গ্রীন টি তে অন্যান্য প্রকারের গ্রীন টি এর তুলনায় পলিফেনলের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। তাই বিশেষজ্ঞরা টি ব্যাগ কিংবা লুজ লিফ সেবনের পরামর্শই দিয়ে থাকেন।
গ্রীন টি এর পুষ্টিগুণ
যেকোন মিষ্টি ছাড়া গ্রীন টি ক্যালরিমুক্ত পানীয় হিসেবে বিবেচিত। সাধারণত প্রতি আট আউন্স কাপ গ্রীন টি তে ২০-২৫ মিলিগ্রামের মত ক্যাফেইন বিদ্যমান, যার প্রায় দুই থেকে তিন গুণ পরিমাণ ক্যাফেইন নরমাল ব্ল্যাক টি এবং কফিতে রয়েছে।
গ্রীন টি পৃথিবীতে প্রাপ্ত সর্বাধিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর পানীয়। গ্রীন টি এর মোট ওজনের প্রায় ২০ থেকে ৪৫ শতাংশই পলিফেনল। এই পলিফেনলের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশে ইজিসিজি জাতীয় ক্যাটেচিন বিদ্যমান।
ক্যাটেচিন সম্পর্কে যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি, ক্যাটেচিন হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি দেহে উৎপন্ন ফ্রি-র্যাডিক্যালের পরিমাণ হ্রাস করে দেহের কোষের ক্ষতিসাধনে বাধা প্রদান করে।
উল্লেখ্য, এসব ফ্রি র্যাডিক্যাল (free radical) বার্ধক্য এবং অন্যান্য রোগ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রীন টি খাওয়ার বিভিন্ন উপকারিতা
ক্ষেত্রবিশেষে গ্রীন টি এর বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে। চলুন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক;
১। উন্নত আয়ুর্বেদ চিকিৎসা
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে এবং চীনে বিভিন্ন ভেষজ ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় গ্রীন টি এর অবদান অনস্বীকার্য। তৎকালীন সময়ে রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতস্থান নিরাময়, দেহের বিপাকক্রিয়ার হার সঠিক রাখা ছাড়াও হজমে সহায়তা করা এবং হৃদরোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সাধন ছিলো গ্রীন টি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য।
২। স্বাস্থ্যকর বায়োঅ্যাকটিভ উপাদানের সমৃদ্ধতা
গ্রীন টি যে শুধু একটি অবসর কাটানোর মত পানীয়ই যে তা কিন্তু নয়। এতে রয়েছে এমন সকল জৈব রাসায়নিক উপাদান, যা আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী।
- প্রথমত, গ্রীন টি তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনল, যা ক্যান্সার প্রতিরোধের পাশাপাশি দেহের বিভিন্ন প্রদাহের প্রশমনে সাহায্য করে।
- দ্বিতীয়ত, গ্রীন টি তে এপিগ্যালোক্যাটেচিন-থ্রি-গ্যালেট (epigallocatechin-3-gallate) বা ইজিসিজি (EGCG) নামক একটি রাসায়নিক উপাদান থাকে, যা ক্যাটেচিন (catechin) জাতীয়। এই ইজিসিজি এর কারণেই একটি ঔষধি পানীয় হিসেবে গ্রীন টি তার পরিপূর্ণতা অর্জন করে।
- তৃতীয়ত, গ্রীন টি তে বেশকিছু উপকারী খনিজ পদার্থও বিদ্যমান।
৩। মস্তিষ্কের কার্যকারিতার উন্নতিসাধন
আমাদের দেহের সকল কাজকর্মের নিয়ন্ত্রণ হয় মস্তিষ্কের মাধ্যমেই। আর এই মস্তিষ্ককে সচল রাখতে গ্রীন টি এর কোন জুড়ি নেই। এক্ষেত্রে গ্রীন টি এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় উপাদানটি হচ্ছে ক্যাফেইন (caffeine), যা আমাদের অন্যতম পরিচিত একটি স্টিমুলেন্ট (stimulant) জাতীয় পদার্থ।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গ্রীন টি তে শতকরা ৪ থেকে ৬ শতাংশ পরিমাণ ক্যাফেইন বিদ্যমান। ব্ল্যাক টি কিংবা কফির মত প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন না থাকলেও গ্রীন টি তে বিদ্যমান ক্যাফেইন কোনরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করেনা।
ক্যাফেইনের গুরুত্ব:
- ক্যাফেইন আমাদের দেহে অ্যাডেনোসাইন (adenosine) নামক একধরনের inhibitory neurotransmitter কে বাধাদানের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্যাফেইন নিউরোনের সক্রিয়তা বজায় রাখে এবং দেহে ডোপামিন (dopamine) এবং নোরেপাইনফ্রাইন (norepinephrine) নামক দুইটি নিউরোট্রান্সমিটারের সামঞ্জস্যতা বজায় রাখে।অ্যাডেনোসাইনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে মাথাব্যথা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, নিম্ন রক্তচাপ, বমি বমি ভাব, নিদ্রাহীনতা, ক্লান্তি ও অবসাদের মত সমস্যা দেখা দেয়।
- ক্যাফেইন আমাদের নার্ভ সচল রাখে, চিন্তাভাবনা এবং সতর্কতাশক্তিকে প্রখর করে এবং ক্লান্তি দূর করে।
- ক্যাফেইনের কারণে আমাদের স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়, সেন্সরি অর্গানগুলোর কর্মক্ষমতা বাড়ে এবং মন মেজাজ প্রফুল্ল থাকে।
মস্তিষ্কের প্রখরতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ক্যাফেইন ছাড়াও অন্য আরেকটি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি হচ্ছে এল থায়ানিন (L-theanine) নামক এক প্রকার অ্যামাইনো এসিড।
এল থায়ানিনের গুরুত্ব:
- এল থায়ানিন জিএবিএ (GABA) নামক এক প্রকার inhibitory neurotransmitter এর কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে, যা মানসিক উদ্বিগ্নতা দূর করতে সক্ষম।
- এল থায়ানিনের কারণে মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং আলফা ওয়েভের উৎপাদন হার বৃদ্ধি পায়।
- এল থায়ানিন রক্ত এবং মস্তিষ্কের মধ্যকার বাধা অতিক্রম করতে পারে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, গ্রীন টি তে ক্যাফেইন এবং এল থায়ানিন নামক উভয় উপাদানের সংমিশ্রণ মস্তিষ্কের কর্মপ্রখরতার পক্ষে অনেক উপকারী।
তাছাড়া বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গিয়েছে যে, গ্রীন টি তে কফির তুলনায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম মাত্রায় ক্যাফেইন থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষই গ্রীন টি পানের ফলে কফির তুলনায় অধিক কর্মক্ষমতা এবং স্থিতিশীল শক্তি অর্জন করতে পেরেছেন।
৪। ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর
মানবদেহের কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির ফলাফল হচ্ছে ঘাতকব্যাধি ক্যান্সার রোগ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যেকোন ধরণের অক্সিডেটিভ ড্যামেজের কারণেই দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের সৃষ্টি হয়, যা ক্যান্সারসহ যেকোন দীর্ঘমেয়াদী রোগের কারণ।
আর এই অক্সিডেটিভ ড্যামেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ উপাদান, যা গ্রীন টি তে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে।
বেশকিছু গবেষণা থেকে নিম্নোক্ত ক্যান্সারজনিত রোগসমূহের বিরুদ্ধে গ্রীন টি তে বিদ্যমান কিছু রাসায়নিক উপাদানের কার্যকারিতা পাওয়া গিয়েছে, অর্থাৎ এসব রোগ প্রতিরোধে গ্রীন টি এর উপকারিতা লক্ষনীয়, যেমন;
-
ব্রেস্ট ক্যান্সার (Breast cancer)
বেশকিছু ব্রেস্ট ক্যান্সার আক্রান্ত বা ঝুঁকিপ্রাপ্ত নারীদের উপর পর্যবেক্ষন গবেষণা চালিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, যেসব নারীরা নিয়মিত গ্রীন টি পান করেছেন তাদের মাঝে ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ২০-৩০ শতাংশ কমে গিয়েছে।
-
প্রোস্টেট ক্যান্সার (Prostate cancer)
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গ্রীন টি পান করেন এমন পুরুষদের প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কম।
-
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার (Colorectal cancer)
প্রায় ২৯ টি গবেষণার বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গ্রীন টি পান করেন এমন ব্যক্তিদের মাঝে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ৪২% কম।
শুধু উপর্যুক্ত ক্যান্সারসমূহই নয়, আরো বেশকিছু ক্যান্সার প্রতিরোধে গ্রীন টি এর ভূমিকা খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। যেমনঃ
- ওভারিয়ান ক্যান্সার (ovarian cancer)
- ব্ল্যাডার ক্যান্সার (bladder cancer)
- লাংস ক্যান্সার (lungs cancer)
- স্কিন ক্যান্সার (skin cancer)
- স্টমাক ক্যান্সার (stomach cancer)
- ইসোফ্যাগেল ক্যান্সার (esophageal cancer)
যদিও গ্রীন টি এর ঠিক কোন উপাদানটি ক্যান্সারের কোষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং মেকানিজমে অংশ নেয় তা এখনো অনিশ্চিত।
তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞদেরই ধারণা এই যে, গ্রীন টি তে প্রচুর পরিমাণে থাকা পলিফেনল ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলো ধ্বংস করে এবং সেগুলোর বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে।
ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের গবেষণা মোতাবেক, গ্রীন টি তে থাকা পলিফেনল শরীরে টিউমারের হার বৃদ্ধির পরিমাণ হ্রাস করে এবং সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ত্বকের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করে।
তবে ২০০৫ সালে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (Food and Drug Administration) অর্থাৎ এফডিএ (FDA) কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গ্রীন টি সেবনের মাধ্যমে কোলন, অগ্ন্যাশয়, ফুসফুস সহ অন্যান্য ক্যান্সার নিরাময় এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হ্রাস করার পেছনে কোন পর্যাপ্ত তথ্য বা প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে আরো গবেষণা বাকি রয়েছে।
তবুও বিশেষজ্ঞরা ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়াতে দৈনিক ২ থেকে ১০ কাপ গ্রীন টি সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
৫। ফ্যাট বার্ন (fat burn) এ কার্যকর
প্রথমত, দেহের ফ্যাটি টিস্যু বার্ন করার ক্ষেত্রে গ্রীন টি এর উপকারিতা ও ভূমিকা অনবদ্য। ভিন্ন ভিন্ন গবেষণাতে এটি দেখা গিয়েছে যে, প্রায় ৪% থেকে ১৭% ক্ষেত্রেই গ্রীন টি সেবনের ফলে ক্যালরি বার্নের মাত্রা বেড়েছে।
তবে দেহের বিপাকক্রিয়া অর্থাৎ মেটাবলিজমের হার নিয়ন্ত্রণের পেছনে গ্রীন টি এর কোন ভূমিকা আছে কিনা তা এখনো নিশ্চিত হতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে এই বিষয়ে গবেষণার ধরণ এবং একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রার মানের উপর।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রীন টি তে বিদ্যমান ক্যাফেইন দেহের ফ্যাটি টিস্যু থেকে ফ্যাটি এসিডগুলো আলাদা করে সেগুলোকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে আমাদের দেহ দীর্ঘসময় পর্যন্ত সতেজ এবং কর্মক্ষম থাকে।
৬। ক্রমবর্ধমান ওজন হ্রাসে সহায়ক
গ্রীন টি সেবনের ফলে যেহেতু ফ্যাটি টিস্যুগুলো বার্ন হয়ে থাকে, সেহেতু এটি ওবেসিটি (obesity) এবং ক্রমবর্ধমান ওজন হ্রাসেও বেশ উপকরিতা পাওয়া যায়। এছাড়াও মেটাবলিজমের হার নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমেও গ্রীন টি ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়ে থাকে।
২৪০ জন ব্যক্তির উপর প্রায় ১২ সপ্তাহের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গ্রীন টি দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মেদ, বিশেষ করে কোমর ও পেটের মেদ কমানোর মাধ্যমে ওজন হ্রাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
তবে এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরো উন্নত গবেষণা চালানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
৭। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
২০০৬ সালে ’জার্নাল অফ দ্যা অ্যামেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (Journal of the American Medical Association)’ এ প্রকাশিত একটি গবেষণার ফল অনুযায়ী, একজন গ্রীন টি সেবনকারী তার জন্যে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে মৃত্যুহার কমাতে সক্ষম।
১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ বছর ধরে হওয়া সেই গবেষণাটিতে ৪০ থেকে ৭৯ বছর বয়স্ক প্রায় ৪০০০০ জন জাপানিজ অংশ নিয়েছিলেন।
এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যারা দৈনিক ৫ কাপ করে গ্রীন টি খেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে দৈনিক এক কাপ করে গ্রীন টি খাওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে কার্ডিওভাস্কুলার রোগ অর্থাৎ যেকোন হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশ কম।
এখন আসা যাক গ্রীন টি ঠিক কীভাবে আমাদের দেহে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় সেই বিষয়ে।
আমরা জানি, আমাদের দেহে বেশকিছু খারাপ কোলেস্টেরল যেমন এলডিএল কোলেস্টেরল (LDL cholesterol) হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। গ্রীন টি আমাদের দেহে এসব খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে।
একই সাথে গ্রীন টি আমাদের দেহে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এই এলডিএল কণাগুলোকে অক্সিডেশনের হাত থেকে রক্ষা করে। মূলত এলডিএল কণাগুলোর অক্সিডেশনের কারণেই আমাদের দেহে হৃদরোগের মাত্রা ত্বরান্বিত হয়।
যারা এলডিএল (LDL) সম্পর্কে জানেন না তাদের জন্য সংক্ষেপে বলছি। এলডিএল হচ্ছে লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (Low-density lipoprotein), যা আমাদের দেহে অন্যান্য কোলেস্টেরল তৈরিতে সাহায্য করে থাকে এবং ধমনীতে চর্বির মাত্রা বাড়ায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগটিকে অ্যাথেরোস্কেলেরোসিস (atherosclerosis) বলা হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, যারা দৈনিক গ্রীন টি পান করে, তাদের ক্ষেত্রে কার্ডিওভাস্কুলার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার সম্ভাবনা ৩১ শতাংশ কম।
এছাড়াও ‘জার্নাল অফ দ্যা অ্যামেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের’ স্ট্রোক সংক্রান্ত গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক গ্রীন টি সেবনের ফলে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমতে থাকে।
৮। টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর
বর্তমান বিশ্বে টাইপ টু ডায়াবেটিস একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। রক্তে শর্করার হার অতিরিক্ত বেড়ে গেলে দেহে ইনসুলিন উৎপাদনের মাত্রা একদম কমে যেতে থাকে, আবার অনেকসময় চিরস্থায়ীভাবে বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গ্রীন টি ইনসুলিনের উৎপাদনের মাত্রা ত্বরান্বিত করে রক্তের শর্করার হার কমিয়ে দিতে সক্ষম।
জাপানে হওয়া একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যারা তাদের খাদ্যতালিকায় দৈনিক গ্রীন টি রাখেন, তাদের মাঝে টাইপ টু ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা প্রায় ৪২% কম।
৯। মস্তিষ্কের বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণ
মস্তিষ্ককে সচল রাখাই যে গ্রীন টি এর কাজ তা কিন্তু নয়। অকাল বার্ধক্যের হাত থেকে মস্তিষ্ককে রক্ষা করাও গ্রীন টি এর অন্যতম উপকারিতা।
আধুনিক বিশ্বে মস্তিষ্কের বার্ধক্যজনিত রোগসমূহের মাঝে অ্যালঝেইমার ডিজিজ (Alzheimer’s disease) এবং পারকিনসনস ডিজিজ (Parkinson’s disease) অন্যতম।
-
অ্যালঝেইমার ডিজিজ
এটি মূলত একটি নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজিজ (neurodegenerative disease), যা বয়স্ক ব্যক্তিদের ডিমেনশিয়ার (dementia) কারণ।
২০১১ সালে অ্যালঝেইমার আক্রান্ত কিছু রোগীর উপর একটি গবেষণা করা হয়। সেখানে তাদেরকে গ্রীন টি তে বিদ্যমান CAGTE (“colon available” green tea extract) সেবন করানো হয়। গবেষণা শেষে বেশিরভাগ রোগীই এই মন্তব্য করেছেন যে তারা আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সুস্থবোধ করছেন।
তবে অ্যালঝেইমার রোগ এবং গ্রীন টি এর মাঝে সম্পর্ক খুঁজতে গেলে আরো আধুনিক গবেষণার দরকার।
-
পারকিনসনস ডিজিজ
অ্যালঝেইমার ডিজিজের মত এটিও একটি নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজিজ। এর কারণে মস্তিষ্কে ডোপামিন তৈরিতে সক্ষম এমন সব নিউরন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
’সাইকোফার্মাকোলজি (Psychopharmacology)’ জার্নালে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, গ্রীন টি আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তির মাত্রা বৃদ্ধি করে। এর ফলে দুঃশ্চিন্তা, মানসিক অবসাদের মত জটিলতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
১০। মুখের দুর্গন্ধ দূর করে
স্ট্রেপটোকক্কাস মিউটানস (Streptococcus mutans) নামক একটি সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার কারণে মুখগহ্বর এবং দাঁত ও মাড়ি ক্ষয় হয়ে থাকে। এর কারণে মুখে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়।
টেস্ট টিউব গবেষণার মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে, গ্রীন টি তে বিদ্যমান ক্যাটেচিন এসব ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে এবং মুখগহ্বরের ইনফেকশন থেকে দেহকে রক্ষা করে। ফলশ্রুতিতে মুখের দুর্গন্ধও দূর হয়।
১১। ত্বকের প্রদাহজনিত রোগ নিরাময়
২০০৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গ্রীন টি ড্যান্ড্রাফ অর্থাৎ খুশকি সমস্যা এবং সোরিয়াসিস (psoriasis) এর মত ত্বকের রোগসমূহ নিরাময়ে বেশ প্রতিশ্রুতিশীল। এই গবেষণায় আরো জানা যায়, গ্রীন টি নিয়মিত সেবনের ফলে ত্বকের কোষসমূহে এমন একটি জিনের উপস্থিতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা আমাদের দেহকোষের জীবনচক্র নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
এছাড়াও FDI গ্রীন টি এর নির্যাস থেকে তৈরিকৃত সাইনেক্যাটেচিনস (sinecatechins) নামক একটি টপিকাল মলমকে জেনিটাল রোগসমূহে ব্যবহারের স্বীকৃতি দিয়েছে। উল্লেখ্য, সাইনেক্যাটেচিনস এর ব্র্যান্ড নাম Veregen।
গ্রীন টি খাওয়ার নিয়ম
আমরা অনেকেই গ্রীন টি পান করে থাকলেও সঠিক পদ্ধতি না জানার অভাবে তা আমাদের দেহে গ্রীন টির যথার্থ উপকারিতা পান না বা সঠিকভাবে কাজ করে না। নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে গ্রীন টি তৈরি করলে তা মস্তিষ্ককে দীর্ঘক্ষণ শান্ত রাখতে সক্ষম:
প্রথমত, টগবগে ফুটন্ত পানিতে কখনই গ্রীন টি দেয়া উচিত নয়। এতে করে গ্রীন টি তে বিদ্যমান ক্যাটেচিন নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ৮০ থেকে ৮৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার পানিতে গ্রীন টি দেয়া ভাল।
দ্বিতীয়ত, পানিতে গ্রীন টি দেয়ার পর অন্তত ৩ মিনিট অপেক্ষা করা উচিত। তিন মিনিটে গ্রীন টি এর নির্যাস ভালমত পানিতে মিশে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, স্বাদ বৃদ্ধির জন্য গ্রীন টি তে পরিমাণমত লেবুর রস ও মধু ব্যবহার করা যেতে পারে। লেবুতে থাকা ভিটামিন সি ক্যাটেচিন শোষণে সাহায্য করে। তবে গ্রীন টি তে কখনোই দুধ কিংবা চিনি ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।
গ্রীন টি এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
গ্রীন টি শরীরের পক্ষে বেশ উপকারী হলেও ক্ষেত্রবিশেষে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। যেমন:
- প্রথমত, যাদের ক্যাফেইন গ্রহণে বেশ সংবেদনশীলতা রয়েছে, তাদের জন্য অতিরিক্ত গ্রীন টি এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়। কেননা দেহে প্রয়োজনের তুলনায় ক্যাফেইনের মাত্রা বেড়ে গেলে অনিদ্রা, বমি বমি ভাব বা পাকস্থলীর সমস্যা হতে পারে।
- দ্বিতীয়ত, যারা কোমাডিন (Coumadin) কিংবা ওয়ারফারিন (warfarin) এর মত অ্যান্টিকোয়েগুলেন্ট ড্রাগস (anticoagulant drugs) সেবন করে থাকেন, তাদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সতর্কতার সাথে গ্রীন টি পান করা। গ্রীন টি তে বিদ্যমান ভিটামিন কে এর জন্যেই চিকিৎসকেরা এই সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন।
এছাড়াও অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রীন টি এবং অ্যাসপিরিন সেবন উভয়েই অনুচক্রিকার রক্ত জমাট বাঁধার কার্যকারিতা হ্রাস করে।
- তৃতীয়ত, স্টিমুলেন্ট ড্রাগসের সাথে গ্রীন টি সেবন করা হলে তা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়
- চতুর্থত, গর্ভবতী মা কিংবা যেসব মায়েদের শিশুরা বুকের দুধ পান করে, তাদের জন্য দৈনিক ৩০০ মিলিগ্রামের বেশি (অর্থাৎ ৬ কাপ) ক্যাফেইন সেবন মোটেও উচিত নয়। তাদেরকে গ্রীন টি এর নির্যাস কিংবা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণেও বিরত থাকতে বলেন চিকিৎসকেরা।
- FDA মোতাবেক, যারা হৃদরোগ, কিডনি বা লিভারের সমস্যা, পাকস্থলীর আলসার কিংবা উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাদেরও গ্রীন টি সাপ্লিমেন্ট সেবনে সতর্ক থাকা উচিত।
শেষ কথা
গ্রীন টি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মত মারণব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করে দেহকে সুস্থ রাখতে পারে। আর এভাবেই গ্রীন টি সুস্থ্য, সবল ও দীর্ঘমেয়াদী জীবনযাপনে সহায়ক চাবিকাঠির আরেক নাম।
আশা করি, গ্রিন টি এর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আপনার স্পষ্ট ধারনা হয়েছে। তাই, গ্রিন টি খাওয়ার নিয়ম মেনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিহীন গ্রীন টি এর উপকারিতা নিন , সুস্থ্য থাকুন।