প্রতি বছর গ্রীষ্মকালীন এই সময়টাতে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রকট আকার ধারণ করে। বর্তমান সময়ে করোনার প্রকোপের পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষের মাঝে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৪০০ মিলিয়ন ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে, যার মধ্যে প্রায় ৯৬ মিলিয়ন রোগে পরিণত হয়।
ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ দেখে নিশ্চিত হলে কি কি করণীয় তা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আসুন প্রথমেই জেনে নেয়া যাক ডেঙ্গু জ্বর কি, কেন হয়, ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ এবং প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
ডেঙ্গু কি?
ডেঙ্গু (Dengue) মূলত এডিস মশা বাহিত এক ধরণের ভাইরাল সংক্রমণ, যা বিশ্বব্যাপী গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে ঘটে থাকে, বিশেষ করে শহুরে এবং আধা-শহুরে বা মফঃস্বল এলাকায় এর প্রকোপ মারাত্মক।
ডেঙ্গু সৃষ্টির জন্য দায়ী ভাইরাসটিকে বলা হয় ডেঙ্গু ভাইরাস বা সংক্ষেপে ডিইএনভি (DENV)।
ডেঙ্গু জ্বরের কারণ কি?
Flaviviridae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই DENV এর ক্ষেত্রে সচরাচর চারটি স্বতন্ত্র অথচ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সেরোটাইপ লক্ষ্য করা যায়, যার অর্থ হল এই ভাইরাস দ্বারা চারবার সংক্রমিত হওয়া সম্ভব। এই চারটি সেরোটাইপ হলো;
- DENV-1
- DENV-2
- DENV-3 এবং
- DENV-4
ডেঙ্গু জ্বর উল্লেখিত চার ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের যেকোন একটির কারণে হয়। উল্লেখ্য, ওয়েস্ট নাইল ইনফেকশন (West Nile infection) এবং পীতজ্বর বা ইয়েলো ফিভার (yellow fever) এর সংক্রমণজনিত ভাইরাসের সাথে এই DENV ভাইরাস ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।
ডেঙ্গু কীভাবে ছড়ায়?
ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশা কামড়ালে ভাইরাস মশার মধ্যে প্রবেশ করে। তারপর, যখন আক্রান্ত মশা অন্য ব্যক্তিকে কামড়ায়, ভাইরাসটি সেই ব্যক্তির রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণের কারণ হয়।
প্রাথমিক সংক্রমণ থেকে আরোগ্য লাভের পর সেই নির্দিষ্ট সেরোটাইপের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় থাকে বলে ধারণা করেন গবেষকরা।
তবে, সুস্থ হবার পরেও অন্যান্য সেরোটাইপগুলিতে ক্রস-ইমিউনিটির সম্ভাবনা আংশিক, অস্থায়ী, এবং অনেকক্ষেত্রে অনিশ্চিতও বটে।
অন্যান্য সেরোটাইপ দ্বারা পরবর্তী সংক্রমণ অর্থাৎ সেকেন্ডারি ইনফেকশন মারাত্মক ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এর মানে হল যে আপনি ভবিষ্যতে আবার অন্য তিন ধরনের ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমিত হতে পারেন।
ডেঙ্গু জ্বর কোন ছোঁয়াচে রোগ নয় অর্থাৎ, সংক্রমিত ব্যক্তির আশেপাশে থেকে সরাসরিভাবে ডেঙ্গু জ্বর হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এটি শুধুমাত্র মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কি কি?
ক্ষেত্রবিশেষে অনেকেই ডেঙ্গু সংক্রমণের কোন প্রাথমিক লক্ষণ বা উপসর্গ অনুভব করেন না। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তখন সাধারণ অসুস্থতাজনিত লক্ষণ বা ভাইরাল ইনফেকশন মনে করে অনেকেই ভুল করতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ, ফ্লু এর কথা বলা যেতে পারে, যা সাধারণত সংক্রামিত মশা কামড়ানোর চার থেকে দশ দিন পরে শুরু হয়। এক্ষেত্রে ফ্লু-কে অনেকে অজান্তেই গুরুত্ব না দিলে তা একসময় মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
ডেঙ্গু সংক্রমণের কারণে জ্বরের মাত্রা উচ্চপর্যায়ের হয় – ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং একই সাথে নিচের লক্ষণ ও উপসর্গগুলিও দেখা দেয়:
- মাথাব্যথা
- পেশী, হাড় বা জয়েন্টে ব্যথা
- বমি বমি ভাব বা বমি
- চোখের পিছনে ব্যথা
- গ্রন্থি ফুলে যাওয়া
- ত্বকে ফুসকুড়ি বা র্যাশ হওয়া (জ্বর শুরুর দুই থেকে পাঁচদিনের মাঝে পরিলক্ষিত হয়)
অধিকাংশ মানুষ এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো আরও খারাপ পর্যায়ের দিকে যায় এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে সিভিয়ার বা মারাত্মক ডেঙ্গু (severe dengue), ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (dengue hemorrhagic fever) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (dengue shock syndrome) বা ডিএসএস (DSS) বলে।
সিভিয়ার ডেঙ্গু জ্বর কখন হয়?
মানবদেহের রক্তনালীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত এবং ফুটো হয়ে গেলেই সিভিয়ার ডেঙ্গু দেখা দেয়। এক্ষেত্রে দেহের রক্ত প্রবাহে জমাট বাঁধার কোষের অর্থাৎ প্লাটিলেটের (platelets) সংখ্যা কমে যায়।
তবে জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ হওয়া সত্ত্বেও মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী খুব দ্রুতই সুস্থ হতে পারে। সাধারণত সিভিয়ার ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো জ্বর আসার প্রথম বা দ্বিতীয় দিন পর শুরু হয়, সেগুলো নিম্নরূপ:
- তীব্র পেট ব্যথা
- ক্রমাগত বমি
- মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত
- প্রস্রাবে রক্ত, মল বা বমি
- ত্বকের আভ্যন্তরীণ রক্তপাত, যা দেখতে ক্ষতের মত হতে পারে
- শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বাভাবিকতা (দ্রুত কিংবা কষ্টবোধ করা)
- ক্লান্তি
- বিরক্তি বা অস্থিরতা
- লিভার বড় হয়ে যাওয়া
- সংবহনতন্ত্রের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া
ডেঙ্গু রোগে ঝুঁকির পেছনে কারণ সমূহ
ডেঙ্গু জ্বর বা রোগের গুরুতর আকার ধারণ করার ঝুঁকি বেশি থাকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর জন্য:
১। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের প্রভাব
সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর সৃষ্টিকারী ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ভারতীয় উপমহাদেশ
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
- পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ
- আফ্রিকা
- দক্ষিণ চীন
- তাইওয়ান
- ক্যারিবিয়ান (কিউবা এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ ছাড়া)
- মেক্সিকো
- মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা (চিলি, প্যারাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা বাদে)
এছাড়াও সাম্প্রতিককালে ইউরোপে স্থানীয় পর্যায়ের প্রাদুর্ভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলসহ নতুন কিছু এলাকায় (টেক্সাস-মেক্সিকো সীমান্তে) এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
২। পূর্বে আক্রান্ত হন নি
প্রাপ্তবয়স্ক এবং একটু বড় বয়সের শিশু-কিশোরদের তুলনায় যারা একদম ছোট বাচ্চা ( শিশু) এবং এর আগে কখনই ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হননি তাদের জন্য ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি।
তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রাথমিক সংক্রমণ থেকে আরোগ্য লাভের পর যদি আবার কারো ডেঙ্গু জ্বর হয় তবে গুরুতর ডেঙ্গু জ্বর (সিভিয়ার) হবার ঝুঁকি বাড়ে।
৩। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে
ডেঙ্গু জ্বরের পূর্ববর্তী রেকর্ড ছাড়াও দুর্বল ইমিউন সিস্টেম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হওয়ার ঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হয়।
ডেঙ্গু পরবর্তী শারীরিক জটিলতাসমূহ
সিভিয়ার ডেঙ্গু জ্বরের ফলে রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যায়, যার ফলে রোগী প্রচণ্ড শক পায়। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ রক্তপাত, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতায় ব্যর্থতা, অর্গান ড্যামেজ বা অঙ্গ ক্ষতি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীদের প্রসবের সময় শিশুর দেহে ভাইরাস ছড়াতে পারে। উপরন্তু, গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীদের ক্ষেত্রে প্রি-টার্ম বার্থ (pre-term birth), লো বার্থ ওয়েইট (low birth weight) এমনকি ভ্রুণের ঝুঁকি থাকতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে?
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বা হেমোরোজিক ফিভারের পাশাপাশি ডেঙ্গু জ্বরের মৃদু বা হালকা লক্ষণগুলো দেখা দিলেও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
এর পাশাপাশি যদি কোন ব্যক্তি ডেঙ্গু কবলিত এলাকায় ভ্রমণ করে থাকেন, সেক্ষেত্রেও পূর্ববর্তী সতর্কতাবিধি গ্রহণ করা জরুরি।
ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তাররা ব্লাড টেস্টের সাহায্যে ভাইরাস বা এন্টিবডি পরীক্ষা করে ডেঙ্গু সংক্রমণ নির্ণয় করতে পারেন। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ভ্রমণের পর কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার অবশ্যই চিকিৎসককে জানানো উচিত।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
ডেঙ্গু সংক্রমণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাধারণত কোন নির্দিষ্ট ঔষধপত্র প্রেসক্রাইব করেন না। কোন ব্যক্তি যদি আশঙ্কা করেন যে তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত, সেক্ষেত্রে তার উচিত নিম্নলিখিত বিধিনিষেধগুলো অবলম্বন করা:
- চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অ্যাসটামিনোফেন (acetaminophen) জাতীয় ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করা।
- যথাযথ বিশ্রাম গ্রহণ করা
- প্রচুর পরিমাণে পানি এবং অন্যান্য পুষ্টিকর তরল পানীয় পান করা
ডেঙ্গু জ্বর থেকে সুস্থ হওয়ার সময়টুকুতে যদি পানিশূন্যতার নিম্নলিখিত লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে অতিসত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত:
- প্রস্রাব কমে যাওয়া
- অশ্রুগ্রন্থির অক্ষমতার কারণে চোখের পানি কমে যাওয়া বা একদমই না থাকা
- মুখ বা ঠোঁট শুকিয়ে আসা
- অলসতা বা বিভ্রান্তি
- ঠান্ডা অনুভব করা
যদি সিভিয়ার ডেঙ্গু দেখা দেয় তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত:
- হাসপাতালে সাপোর্টিভ কেয়ারে রাখা
- রক্তচাপ পর্যবেক্ষণে রাখা
- ইন্ট্রাভেনাস (Intravenous) বা আইভি (IV) ফ্লুইড এবং ইলেকট্রোলাইট রিপ্লেসমেন্ট (electrolyte replacement) করা
- রক্তের ক্ষতি প্রতিস্থাপনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া
ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে করণীয়
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোগধ উত্তম। সুতরাং, ডেঙ্গুর মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে প্রতিরোধ করে বাঁচার সুযোগ থাকলে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। চলুন জেনে নেওয়া যাক ডেঙ্গু রোগ সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় গুলো কি কি!
১। ভ্যাকসিন গ্রহণ
সাধারণ জনগণকে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কোনরূপ ভ্যাকসিন না থাকলেও ৯-৪৬ বছর বয়সী মানুষদের মধ্যে যারা পূর্বে অন্তত একবার হলেও ডেঙ্গু দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে অর্থাৎ যারা সেরোপজেটিভ (seropositive), তাদের উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালে এফডিএ (FDA) কর্তৃক ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া (Dengvaxia) নামক একটি ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়।
এই ভ্যাকসিনের মূল উদ্দেশ্যই হলো পরবর্তীতে যাতে তারা পুনরায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হয়। সাধারণত ১২ মাসের মধ্যে তিনটি ডোজে এই ভ্যাকসিনটি দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, অতীতে যাদের অন্তত একবার হলেও ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটেনি অর্থাৎ যারা সেরোনেগেটিভ (seronegative), তারা এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে ডেঙ্গু সংক্রমণের কারণে মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বর এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা।
২। মশার কামড় প্রতিরোধ
ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন (World Health Organization) এর মতে, ডেঙ্গু সংক্রামিত এলাকায় ডেঙ্গু জ্বর কমাতে ভ্যাকসিন একমাত্র কার্যকরী হাতিয়ার নয়। মশার কামড় প্রতিরোধ এবং মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার রোধের প্রধান পদ্ধতি।
ডেঙ্গুর সংক্রমণজনিত এলাকায় বসবাসকারী বা ভ্রমণকারীরা নিম্নলিখিত পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে মশার কামড়ের ঝুঁকি কমাতে পারেন:
১। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকলেও তারা রাতেও কামড়াতে পারে। তাই সম্ভব হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকা উচিত। এছাড়াও ঘরের জানালা এবং দরজাগুলো নিরাপদ এবং ছিদ্র মুক্ত কিনা সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকা উচিত।
২। ঘরের ভেতর মশা তাড়ানোর যন্ত্র যেমন মসকিউটো রিপেলেন্ট মেশিন (mosquito repellent machine) ব্যবহার করা জরুরি। তবে কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সেগুলো পরিবেশবান্ধব কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে।
৩। প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরিধান করা উচিত। মশা উপদ্রুত জায়গায় বসবাসকারীদের উচিত লম্বা হাতাযুক্ত পোষাক, লম্বা প্যান্ট, মোজা এবং জুতা পরার অভ্যাস করা।
৪। ছোট শিশুদের সুরক্ষার জন্য মসকিউটো রিপেলেন্ট ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা জরুরি।
৫। মশার উপদ্রব ঠেকাতে অবিলম্বে মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা বাঞ্ছনীয়। যেসব মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে তারা সাধারণত বাড়িতে এবং আশেপাশের জলা জায়গায় বাস করে এবং ডাবের মালা, গাড়ির ব্যবহৃত চাকা, ভাঙা টব বা ফুলদানির মত পরিত্যক্ত জিনিসে জমে থাকা পানিতে বংশবৃদ্ধি করে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমাদের উচিত মশার এসব আবাসস্থল ধ্বংস করা।
এছাড়াও সপ্তাহে কমপক্ষে একবার খালি এবং পরিষ্কার পাত্রে যেমন ফুলের টব, গাছ লাগানোর পিপেতে জমে থাকা অতিরিক্ত পানি পরিষ্কার করা উচিত। পাশাপাশি আবাসস্থলের পার্শ্ববর্তী জায়গায় আগাছা বা ঘন ঝোপঝাড় থাকলে তা অবিলম্বে সাফ করা জরুরি।
৬। বাড়িতে কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে নিজেকে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মশার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টায় সতর্ক থাকতে হবে। কেননা পরিবারের সংক্রমিত সদস্যকে কামড়ানো মশা আপনার বাড়ির অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খাবেন, কি খাবেন না?
ডেঙ্গু থেকে সুস্থতার মাত্রা অনেকাংশেই নির্ভর করে সুষম খাদ্যাভ্যাসের পরিকল্পনার উপর। সঠিক খাবার আপনাকে ডেঙ্গুর বিভিন্ন উপসর্গ থেকেও মুক্তি দেয়ার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে।
সুনির্দিষ্ট ডায়েট প্ল্যান অবলম্বন করার পাশাপাশি ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ঔষধ সেবনের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি কিছু অতিরিক্ত স্বস্তি পেতে পারেন।
ডেঙ্গু রোগ হলে যা খেতে পারেন
আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী যেন এমন সব খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গ্রহণে অভ্যস্ত হন যেগুলো তার রক্তে প্লেটলেট সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম। রক্তে প্লেটলেট সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যেসব খাবার খেতে হবে তার মধ্যে রয়েছে:
১। ফোলেট (folate) সমৃদ্ধ খাবার
ফোলেট হচ্ছে সুস্থ রক্তকোষের জন্য অপরিহার্য একধরণের বিশেষ ভিটামিন বি। নিম্নলিখিত খাবারসমূহে ফোলেট বিদ্যমান:
- গাঢ় সবুজ রঙের শাকসবজি যেমন পালংশাক, কলমি শাক, ব্রোকলি ইত্যাদি
- গরুর কলিজা
- লাল চালের ভাত
- ইস্ট
- দুগ্ধজাত দ্রব্য
প্রচুর পরিমাণে ফোলেট সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণে কোন সমস্যা না থাকলেও উচমাত্রার ফোলেট বিশিষ্ট সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়।
২। ভিটামিন বি -১২, সি, ডি এবং কে সমৃদ্ধ খাবার
- ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ খাবারের মাঝে গরুর মাংস ও গরুর কলিজা, ডিম, ফর্টিফাইড সিরিয়াল, কাঠবাদামের নির্যাস সমৃদ্ধ দুধ এবং স্যামন, টুনা ইত্যাদি মাছ উল্লেখযোগ্য। তবে গরুর দুধ পানের ফলে প্লেটলেট উৎপাদনে প্রভাব পড়তে পারে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্লেটলেটের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং একই সাথে দেহের জন্য প্রয়োজনীয় আয়রন শোষণে ভিটামিন সি এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ব্রোকলি, সবুজ এবং লাল ক্যাপসিকাম, সবুজ কাঁচামরিচ, লেবু, কমলা, আঙ্গুর, স্ট্রবেরিতে ভিটামিন সি বিদ্যমান। তবে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল ও সবজি খাওয়ার ক্ষেত্রে তা কাঁচাই খাওয়া বাঞ্ছনীয়, যেহেতু আমরা সবাই জানি যে তাপে ভিটামিন সি এর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।
- ভিটামিন ডি এর কাজ মূলত অস্থিমজ্জার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যার ফলে রক্তে প্লেটলেটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ডিমের কুসুম, মাছের যকৃত ও তেল, টকদই ইত্যাদিতে ভিটামিন ডি আছে।
- প্লেটলেটের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ভিটামিন কে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শালগমের শাক, পালংশাক, মিষ্টি কুমড়া, ব্রোকলি, সয়া বীজ ও সয়াবিন তেলে ভিটামিন কে রয়েছে।
৩। আয়রন (Iron) সমৃদ্ধ খাবার
রক্তকোষের সুস্থ ও স্বাভাবিক মাত্রা ব্যাহত রাখতে আয়রনের কোন বিকল্প নেই। নিম্নলিখিত খাদ্যসমূহ আয়রনের খুব ভাল উৎস হিসেবে বিবেচ্য:
- গরুর কলিজা
- মটরশুঁটি
- কিডনি বীন বা রাজমা
- ডার্ক চকোলেট
- ডাল
- টফু
- শিমের বীচি
চিকিৎসকেরা সাধারণত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণকালে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বা সাপ্লিমেন্ট সেবনে সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেন।
৪। পেঁপে পাতার রস
ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিকারে পেঁপে পাতার রস বেশ উল্লেখযোগ্য একটি উপাদান; কেননা এটি ডেঙ্গু রোগীদের প্লেটলেট সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে। এজন্য পেঁপে পাতার রস বের করে পানিতে মিশিয়ে খেতে হবে। ভালো ফলাফলের জন্য এই পানীয়টি দিনে দুই বা তিনবার পান করা যেতে পারে।
৫। ডাবের পানি
ডেঙ্গুকালীন সময়ে ডিহাইড্রেশন এড়াতে ডাবের পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি দেহে পুষ্টি যোগানোর পাশাপাশি দেহকে হাইড্রেটেড রাখে। দিনে অন্তত দুই গ্লাস ডাবের পানি পান করা উচিত।
৬। ভেষজ চা
উন্নত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিয়মিত ভেষজ চা পানের জুড়ি নেই। আদা চা, এলাচ চা দারুচিনি চায়ের পাশাপাশি গ্রিন টিও ডেঙ্গু প্রতিকারে সহায়ক। ভেষজ চায়ের সতেজ স্বাদ মনকেও সতেজ রাখতে সাহায্য করে।
৭। নিমপাতা
ঔষধি গুণাগুণে ভরপুর নিমপাতা ডেঙ্গুর জন্য একটি কার্যকর ও উপকারী প্রাকৃতিক প্রতিকার। এটি ভাইরাসের বিস্তার রোধ এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ডেঙ্গু রোগ হলে যা যা খাবেন না
- অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়
- ক্র্যানবেরি জুস
- কুইনাইন
- তৈলাক্ত এবং ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয়
- সফট ড্রিংকস
- তেল মশলা ও চর্বিযুক্ত খাবার
- ঔষধের ক্ষেত্রে অ্যাসপিরিন (aspirin), আইবুপ্রোফেন (ibuprofen) জাতীয় ঔষধ সেবনের আগে চিকিৎসকের মতামত গ্রহণ জরুরি।
ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে শেষ কথা
পৃথিবীতে বসবাসরত একটি বৃহৎ শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে এই ডেঙ্গু রোগ। প্রতি বছর মানুষকে ডেঙ্গু প্রতিরোধের পদক্ষেপগুলি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে এটি মহামারী আকারে ছড়াতে না পারে।
তাই, আমাদের উচিত এলাকায় ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় সতর্কতাবিধি অবলম্বন করা।
পাশাপাশি নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে সচেতন হওয়া, যাতে করে আমাদের ছোট একটি ভুলের জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে যেতে না হয়। আশা করি ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আজকের আলোচনা আপনার সেই চেষ্টায় কিছুটা ভূমিকা রাখবে।