ভিটামিন ডি এর কার্যকারিতা- ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার : স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভিটামিনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগানো থেকে শুরু করে খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তর, দৈনন্দিন শারীরিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ, দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে ভিটামিনের জুড়ি নেই। এখন কারো মনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে পারে যে কোন ভিটামিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হেলথলাইন ডটকম এর বিশেষজ্ঞদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনসমূহের তালিকায় প্রথমেই আছে ভিটামিন ডি এর নামটি।

ইতিমধ্যে আমরা ভিটামিন সি জাতীয় খাবার সম্পর্কে জেনেছি। আজ জেনে নিবো ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার সম্পর্কে।

তবে তার আগে আসুন ভিটামিন ডি কি?, এবং এর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একনজরে জেনে নেই।

ভিটামিন ডি কি?

Vitamin D এমন একটি ফ্যাট সল্যুবল (fat-soluble) পুষ্টি উপাদান, যা প্রকৃতিগত উৎস ছাড়াও বেশকিছু খাদ্যে পাওয়া যায়, এমনকি ডায়েট সাপ্লিমেন্ট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

“ফ্যাট সল্যুবল” বিষয়টি সম্পর্কে অনেকেই হয়ত জানেন না। তাদের জন্য বলছি, যেসব খাদ্য উপাদান (বিশেষত ভিটামিন) খাবারের ফ্যাট বা চর্বির সাথে শোষিত হয় এবং দীর্ঘসময় পর্যন্ত দেহের ফ্যাটি টিস্যু (fatty tissue) এবং যকৃতে সংরক্ষিত থাকে, সেগুলোই “ফ্যাট সল্যুবল” ভিটামিন।

ভিটামিন ডি ছাড়াও ভিটামিন এ, ভিটামিন ই ও ভিটামিন কে ফ্যাট সল্যুবল ভিটামিনের তালিকাভুক্ত।

প্রাকৃতিকভাবে আমাদের দেহে ভিটামিন ডি তখনই উৎপন্ন হয়, যখন সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি (ultraviolet rays) আমাদের ত্বকে এসে পড়ে এবং Vitamin D এর সংশ্লেষণে প্রভাব ফেলে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ভিটামিন ডি এর উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদী।

ভিটামিন ডি এর কার্যপ্রক্রিয়া

১। খাদ্য, সূর্যালোক এবং সাপ্লিমেন্ট থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন ডি জৈবিকভাবে নিষ্ক্রিয়। তাই মানবদেহে দুই ধরণের হাইড্রোক্সিলেশন (hydroxylation) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে Vitamin D এর সক্রিয়তা লাভ করে।

আরো পড়ুন:  ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার : ত্বকের যত্নে ভিটামিন-ই

প্রথম হাইড্রোক্সিলেশন প্রক্রিয়ায় ভিটামিন ডি 25-hydroxyvitamin D [25(OH)D] তে রূপান্তরিত হয়, যার আরেক নাম ক্যালসিডাইওল (calcidiol)। এই পুরো প্রক্রিয়াটি মানবদেহের যকৃতে সংঘটিত হয়।

দ্বিতীয় হাইড্রোক্সিলেশন প্রক্রিয়াটি প্রাথমিকভাবে কিডনিতে সংঘটিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় ভিটামিন ডি 1,25-dihydroxyvitamin D [1,25(OH)2D] তে রূপান্তরিত হয়, যার আরেক নাম ক্যালসিট্রাইওল (calcitriol)

২। খাদ্য এবং সাপ্লিমেন্টগুলোতে Vitamin D এর দুটি প্রধান রূপ রয়েছে। এরা হচ্ছে D2 বা এর্গোক্যালসিফেরল (ergocalciferol), এবং D3 বা কোলেক্যালসিফেরল (cholecalciferol)

ভিটামিন ডি এর এই দুই ভিন্ন রূপই ক্ষুদ্রান্তে বেশ ভালভাবে শোষিত হয়। Vitamin D এর এই শোষণ simple passive diffusion প্রক্রিয়া এবং ইনটেস্টাইনাল মেমব্রেন (intestinal membrane) এর সাথে জড়িত প্রোটিন সংক্রান্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘটে।

ক্ষুদ্রান্ত্রে Vitamin D এর শোষণ প্রক্রিয়ায় ফ্যাটের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে অনেকক্ষেত্রে ডায়েটারি ফ্যাটের (dietary fat) উপস্থিতি ছাড়াও ভিটামিন ডি শোষিত হয়।

তবে বার্ধক্যজনিত সমস্যা কিংবা শারীরিক স্থুলকায়তা-কোনটিই ভিটামিন ডি এর শোষণে প্রভাব ফেলে না।

ভিটামিন ডি এর কার্যকারিতা

১। অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের সঠিক মাত্রায় শোষণ নিশ্চিত করে। এর ফলে অস্টিওপোরোসিস (osteoporosis) নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।

২। ক্যালসিয়াম সেরাম এবং ফসফেটের পর্যাপ্ত ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করে হাড়ের অভ্যন্তরীণ খনিজ পদার্থসমূহের কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করে।

এই প্রক্রিয়াটি হাইপোক্যালসেমিক টিটেনি (hypocalcemic tetany) প্রতিরোধ ছাড়াও বোন রিমডেলিং প্রসেসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩। দেহের প্রদাহ হ্রাস ছাড়াও কোষ বৃদ্ধি, নিউরোমাসকুলার ফাংশন (neuromuscular function), ইমিউন ফাংশন (immune function) এবং গ্লুকোজ মেটাবলিজম (glucose metabolism) এর মত বেশকিছু প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভিটামিন ডি এর উৎসসমূহ

বিভিন্ন উৎস হতে আমরা ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে পারি। যেমন:

  • সূর্যালোকের সংস্পর্শে
  • দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে
  • পুষ্টিকর সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে

১। সূর্যালোকের সংস্পর্শে

ভিটামিন ডি সূর্যালোকের উপস্থিতিতে, বিশেষ করে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ত্বকে উৎপন্ন হয়। সাধারণত ২৯০-৩২০ ন্যানোমিটার ওয়েভলেংথ সমৃদ্ধ টাইপ-বি আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি আমাদের দেহত্বকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

আরো পড়ুন:  ভিটামিন সি পাওয়া যায় যেসব খাবারে: ভিটামিন সি জাতীয় খাবার

ভিটামিন D এর উৎস

এতে ত্বকে থাকা  7-dehydrocholesterol প্রাথমিকভাবে প্রিভিটামিন ডি-থ্রিতে (previtamin D3) রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে এই প্রিভিটামিন ডি-থ্রিই ভিটামিন ডি-থ্রিতে পরিণত হয়।

আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি উৎপাদনের হার বেশকিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন:

  • বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরের প্রভাব
  • দিনের নির্দিষ্ট সময় (সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সূর্যালোক বেশ তীব্র থাকে)
  • দেহত্বকের মেলানিনের পরিমাণ
  • শহরের নিকটবর্তী স্থানসমূহে (কেননা সেখানে নিরক্ষীয় অঞ্চলসমূহে অতিবেগুনী আলোর স্তর বিদ্যমান)
  • আকাশে মেঘের পরিমাণ ও বায়ু দূষণ
  • বয়স (বৃদ্ধবয়সের যেকোন মানুষের ত্বকে তুলনামূলকভাবে কম ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়)
  • গ্লাসে ঘেরা কোন ঘরের অভ্যন্তরে থাকলে (যেহেতু গ্লাসের মধ্য দিয়ে অতিবেগুনী রশ্মি প্রবেশ করতে পারেনা)

ত্বকের ধরণভেদে এবং জাতিগত উৎস অনুযায়ী সূর্যালোক থেকে Vitamin D গ্রহণের সময়কাল ভিন্ন হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ফ্যাকাশে বর্ণধারী একজন হয়ে থাকেন, তাহলে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মত সূর্যালোকই আপনার দেহের জন্য পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি তৈরিতে সক্ষম।

পক্ষান্তরে, গাঢ় উজ্জ্বলবর্ণের অধিকারী যারা, তাদের জন্য এক্ষেত্রে সময়টি বেশি লাগতে পারে।

এছাড়াও আফ্রিকান ও দক্ষিণ এশীয়দের ক্ষেত্রেও শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় রোদ থেকে Vitamin D গ্রহণে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়।

তবে সূর্যালোকের মাধ্যমে ভিটামিন ডি গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশকিছু সতর্কতা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। যেমন:

  • যারা স্পর্শকাতর ও নমনীয় ত্বকের অধিকারী, তারা সানস্ক্রিন ব্যবহার করে রোদের সংস্পর্শে যাবেন। বিশেষত যারা ঘন ঘন ঘামেন, তাদের জন্য বিশেষজ্ঞরা প্রতি দুই ঘন্টা পরপর SPF 15 সমৃদ্ধ বেশ ভালোমানের সানস্ক্রিন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
  • ঘণ্টার পর ঘণ্টা কখনই রোদের সংস্পর্শে থাকা উচিত নয়। এতে করে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন প্রদাহ, ভাঁজ পড়া, ফুলে যাওয়া, ত্বকে পোড়া দাগ ছাড়াও ক্যান্সার, চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া এমনকি হিটস্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে।
  • দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে, বিশেষত মধ্যদুপুরের রোদ ত্বকে ভিটামিন ডি তৈরিতে বেশ কার্যকর। তাই সেই সময়টিতেই উচিত দেহত্বককে রোদের সংস্পর্শে আনা।
  • রোদের সংস্পর্শে না থাকতে পারলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
আরো পড়ুন:  ভিটামিন সি পাওয়া যায় যেসব খাবারে: ভিটামিন সি জাতীয় খাবার

২। দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে ভিটামিন ডি

প্রাকৃতিক উৎস ছাড়াও বেশকিছু সুষম খাদ্যের মাঝেও আমরা পেতে পারি Vitamin D. সেজন্য আগে আমাদের জানতে হবে কোন কোন খাবারগুলো ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ ।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (National Institutes of Health) এর ডায়েটারি চার্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে প্রতি একজনের পরিবেশন অনুযায়ী নিম্নে Vitamin D সমৃদ্ধ সুষম খাবার ও পরিমাণ দেওয়া হল:

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার সমূহের তালিকা

খাবারের নাম খাবারের পরিমাণ ভিটামিন ডি এর পরিমাণ (IUs)
কড লিভার অয়েল এক টেবিল চামচ ১৩৬০
রান্না করা স্যামন তিন আউন্স ৫৭০
সোর্ডফিশ (ড্রাই কুকড) তিন আউন্স ৫৬৬
টুকরো করা সাদা, কাঁচা মাশরুম (অতিবেগুনী আলোর সংস্পর্শে থাকা) আধা কাপ ৩৬৬
ক্যানজাত টুনা (পানিতে ভেজানো) তিন আউন্স ১৫৪
ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ কমলার রস বা জুস এক কাপ ১৩৭
ভিটামিন সমৃদ্ধ দুধ এক কাপ ১১৫-১২৪
ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ সয়া, আমন্ড এবং ওটমিল্ক এক কাপ ১০০-১৪৪
২০% ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাঁটি টকদই ছয় আউন্স ৮০
ক্যানজাত সার্ডিন মাছ (তেলে সংরক্ষিত) দুইটি ৪৬
রান্না করা গরুর কলিজা তিন আউন্স ৪২
ডিমের কুসুম বড় সাইজের একটি ৪১
ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল (breakfast cereal) এক কাপ ৪০
চেডার চীজ এক আউন্স ১২
সুইস চীজ এক আউন্স
টুকরো করা পোর্টাবেলা মাশরুম আধা কাপ
মুরগির বুকের মাংস তিন আউন্স

আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় আমিষ, নিরামিষসহ সবরকম ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার রাখা জরুরী।

৩। ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে

ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট

যারা নিরামিষাশী এবং ল্যাক্টোজ সমৃদ্ধ খাবারে যাদের অনীহা বা অ্যালার্জি আছে, তাদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

শেষ কথা

ভিটামিন ডি সংক্রান্ত যেকোনো রোগ প্রতিরোধে সূর্যালোকের সংস্পর্শ এবং সুষম খাদ্যাভ্যাসের কোন জুড়ি নেই। এর সাথে দরকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top